শৈশব

"কত গল্প, কত বাল্যখেলা,
এক বিছানায় শুয়ে মোরা সঙ্গী তিন; (আমি, নানি, মামাতো বোন)
সে কি আজিকার কথা, হল কত দিন।
এখনো কি বৃদ্ধ হয়ে যায় নি সংসার।
ভোলে নাই খেলাধুলা, নয়নে তাহার
আসে নাই নিদ্রাবেশ শান্ত সুশীতল,
বাল্যের খেলনাগুলি করিয়া বদল-
পায় নি কঠিন জ্ঞান?"

শৈশব মানেই কবিগুরুর সেই শৈশব সন্ধ্যা কবিতার কথা মনে পড়ে যায়। কতই না স্বাধীন ছিল সেই সব দিনগুলি। আমার শৈশবের বেশ খানিকটা সময় কেটেছে নানাবাড়িতে, মামাতো ভাই বোনদের সাথে। আলহামদুলিল্লাহ্, আমার তিন মামা। কিন্তু আমার আম্মুর কোনো বোন নেই। আমারো নেই, তবে অনেক বোন হয়ে গেছে কালে কালে। যা-হোক, বড় মামার দুই মেয়ে, মেজো মামার দুই ছেলে আর ছোট মামার দুই ছেলে। এদের মাঝে আমি আর আমার ছোট ভাই। সব মিলে আমরা আট সদস্যের কাজিন নানাবাড়ির দিক থেকে। আমি যখনই নানাবাড়ি যেতাম, বড় মামার বড় মেয়েটাও আসতো। বয়সে আমার বছর দুয়ের বড় হবে, কিন্তু একটু বেশি-ই সহজ সরল ছিল। তার সাথে আমার অসংখ্য স্মৃতির মধ্যে অন্যতম কিছু বেশ দাগ কেটে আছে আজো হৃদয়ে।



একবার আমরা লুকিয়ে মেজো মামাদের রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে তাদের চুলায় চড়ুইভাতি করেছিলাম। সেদিন বাড়ি ফাঁকা ছিল। আরেকবার নানাবাড়ির পেছনেই ঘন জঙ্গল ছিল, সেখানে চড়ুইভাতি করেছিলাম তেঁতুলের খোসায় ভাত রান্না করেছি আর নানি চুলায় ডিম ভেজে দিয়েছিল। তখন সেগুলোই ছিল আমাদের কাছে অনেক বেশি আনন্দের। এখনকার দিনে এইসব শুধুই গল্প। কিন্তু আমার জীবনে এই দিনগুলো ছিল।



প্রতি রাতে, নানা যখন দোকান থেকে চা পান করে বাড়িতে আসতো, আমরা দুই বোন অপেক্ষায় থাকতাম নানা নিশ্চই আমাদের জন্যে কিছু একটা কিনে নিয়ে আসবে। সত্যি নানা খাবার নিয়ে আসতো, কখনো গজা, কখনো কটকটি মিষ্টি-ঝাল আর আমার পছন্দের ঝাল চানাচুর।



 আবার কখনো আমরা দুই বোন মিলে পিঠা বানাতাম আটা-ময়দা, চিনি, ডিম এসব দিয়ে। আপুর কাছেই আমার প্রথম গোলাপ পিঠা বানানো শেখা। আপুর খালামণি মোম দিয়ে শো-পিস বানাতো আর সেগুলো বিক্রীও করতো। আপু তার খালামণির কাছেই গোলাপ পিঠা বানানো শিখেছিল।




একবার তো ছোট মামার বড় ছেলের সুন্নতে খাৎনার অনুষ্ঠানে মামার শ্বশুর বাড়ির লোকেদের সাথে আমরা দুইবোন সেই লেভেলের মজা করেছিলাম। এখন সেসব ভাবলেই লজ্জা -লজ্জা লাগে।  কিসের মধ্যে কি করেছি  হা হা হা!!!!



আমি আর আপু একই স্কুলে পড়তাম।  আপু আমার এক ক্লাস উপরে ছিল। আম্মু যখনি আমাকে স্কুল থেকে আনতে যেত, আপুর জন্যে আর আমার জন্যে ডেনিস, আইসক্রিম কিনে নিয়ে যেত। বড় মামা তখন সৌদিতে ছিলেন। তিনি বিদেশ থেকে সব সময় আমাদের দুইবোনের জন্যে একই রকম জামা, ঘড়ি পাঠাতেন। আর তখনকার ঈদেও দুই বোন একই রকম জামা কিনতাম। তারপর আপুদের বাসায় বেড়াতে যেতাম। আজকে আপুর বিয়ে হয়েছে প্রায় পাঁচ বছর হল। একটা ছেলের জননীও। আপু অনেক ভাল আছে, ভাবতেই ভাল লাগে যে, আপু আজ বেশ সংসারী হয়ে গেছে।



এমনিতেও নানা বাড়িতে আমার বেশি থাকা হয়েছে। আর পড়ালেখা, অন্যান্য দিকেও পারদর্শীতা থাকায় সবার খুবই আদরের ছিলাম। এখনো আছি, শুধু শৈশবটা নেই। নানাবাড়ি মানেই নানির হাতে খাবার খাওয়া, মাটির চুলায় রান্নার সময় নানির পাশে বসে থাকা, গাছের ডাব পেরে আনা পর্যন্ত পিড়ি নিয়ে অপেক্ষায় বসে থাকা। এই তো ভাললাগা।




এই হল আমার শৈশবের নানাবাড়ির গল্প। দাদুবাড়ির গল্পটা ভিন্ন। দাদুকে দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তবে শুনেছি উনি খুবই সুদর্শন ছিলেন। দাদীকে পেয়েছিলাম পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। যেদিন দাদী মারা গেলেন, সেদিন খুব বৃষ্টি ছিল, আমরা সবাই হোসেন জ্যাঠার বাড়িতে গেলাম। দাদী সেখানেই বেশি থাকতো। আর আমাদের বাসায় প্রায়ই হাঁটতে হাঁটতে যেত। আমার জন্যে কাপড়ের আঁচলে বেধে এটা-ওটা নিয়ে যেত। আমি তখন এতই ছোট ছিলাম যে, আদরে মাখা মাখা হয়ে যেতাম।

সৃষ্টিকর্তা আমাকে দাদীর বুকে ঘুমানোর তৌফিক দিয়েছিলেন। কিন্তু বেশিদিন ছিল না সেটা। সেদিনের বৃষ্টিতে আমি নির্বাক শুধু তাকিয়ে ছিলাম, ওরা দাদীকে বৃষ্টির মধ্যেই শেষ গোসল দিয়ে, কাফনের ব্যবস্থা করছিল। আমি খুব ভয় পাচ্ছিলাম। আমার এখনো মনে পড়ে, আমার এক ফুফাতো বোনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, "আপু, বুবুর কি হয়েছে? বুবু এখনো ঘুমায় কেন?" আপু সেদিন আরো আপুদের সাথে ডেকে আমাকে নিয়ে বের হতে চাচ্ছিলো কোথায় যেন। কিন্তু আমি বার বার বলছিলাম, "আমি বুবুর কাছে থাকবো, আমি বুবুর পাশে বসবো, বুবু আমাকে দেখবে..." 

এখন সেই মুহুর্তগুলো ভাবলেই আপনা থেকে চোখজোড়া ভিজে আসে। বুঝিনি,  বুবু তো আর উঠবেনা কোনোদিন, আমায় জড়িয়ে ধরে আঁচল দিয়ে মুখ মুছে দিয়ে বলবেনা, "আজকে স্কুলে পড়া পারছো সব? হাইটা আসতে কষ্ট হইছে? বুবুর কাছে ব্যাগ টা দেও।"

তখন আমি ক্লাস থ্রি তে পড়ি। আব্বু- আম্মু আমাকে কিন্ডারগার্টেন স্কুল থেকে এনে প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি করে দেয়। সেখানে সকাল দশটা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত ক্লাস করে, বাসায় ফিরতে সাড়ে চারটা কি পাঁচটা বেজে যেত। বাসা থেকে স্কুল হাঁটার রাস্তা হলেও বন্ধু-বান্ধবের সাথে কথা বলতে বলতে আসতাম, তাই দেরী হত। বুবু প্রায় প্রতিদিন উপজেলার গেইটে বসে থাকতো। তিনি জানতেন, আমি এই পথেই বাসায় যাই। তিনি আমার ব্যাগটা বহন করার জন্যে আসতেন। এক প্রকার জোর করেই ব্যাগটা তিনি নিতেন। খুব ভারী ছিল আমার জন্যে তখন। সেইদিনগুলো আজো মনের আঙিনায় এসে ভিড় জমায় গভীর মমতায় ঘিরে রাখে।

আত্মীয়ের বাড়ি যাওয়া বলতে মাঝে মাঝে ফুফুদের বাড়ি কিংবা বড় জ্যাঠার বাড়ি যাওয়া হত। আব্বু সব ভাই-বোনদের ছোট হওয়ায়, আমাকে সবাই অনেক বেশি আদর করতো। আমিলা আম্মার বাড়িতে গরমের দিনে গেলে আম, লিচু খাওয়াতো আবার সাথে দিয়েও দিত। যে বার যেতে পারতাম না, সে বার বাসায়ই নিয়ে আসতো উনি নিজেই। বড় আম্মার বাড়ি থেকেও আম, লিচু, বড়ই, পিঠা এসব দিয়ে যেত। খুব কমই যাওয়া হত সেখানে। আর জ্যাঠাদের তো আদরের মণি ছিলাম, তারাও অনেক যত্ন করতো। সবচেয়ে বেশি যাওয়া হত মায়া আম্মুর বাসায়, আর উনিও আসতেন অনেক বেশি। মানে আসা-যাওয়াটা বেশি ছিল উনাদের বাড়িতেই। তবে হ্যাঁ, রহস্য আছে।  তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে একটু বেশি-ই আদর করতেন আমায়। এখনো করেন। তখন জমিতে এটা ওটা চাষ করতেন আর বাসায় নিয়ে আসতেন শাক, সবজি, ফল, পুকুরের মাছ যখন যা হত তাই নিয়ে আসতেন আমার জন্যে। একবার তিনি লাল শাক আর ডাটা শাক নিয়ে এসেছিলেন, সেগুলো ছিল বিশেষ হাতে বপনকৃত। হা হা হা!!! 



ছোটবেলা থেকেই শুনতাম, উনার ছোট ছেলের সাথে আমার বিয়ে হবে। সেজন্য একটু বেশি-ই মাখন টাইপের সম্পর্ক আর কি।  হা হা হা!!! কেউ কেউ বলতো, ছোটবেলায় আমাকে বউ সাজিয়ে আর উনার ছোট ছেলেকে বর সাজিয়ে বিয়েও নাকি দেয়া হয়েছে। একটা ছবিও আছে সেই বিয়ের। হা হা হা!!! আমি তো বিশ্বাসই করতাম না। কিন্তু একবার দেখেছি সেই ছবি, আর নিজের চোখকে বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। সত্যি-ই তো আমার বিয়ে হয়ে গেছে! ছোট থেকে একটা অন্যরকম অনুভূতি জন্মে গিয়েছে উনার ছোট ছেলের প্রতি। মাঝে মধ্যেই আমাদের বাসায় আসতো বা বিভিন্ন জায়গায় দেখা হত। আর আমার সে যে কি লজ্জা লাগতো! নিজেকে কখনো কখনো তার বউ হিসেবেই ভাবতাম। আর এই কাহিনি তাদের বাড়ির আশেপাশের পাড়া-প্রতিবেশীরাও জানতো যে আমিই ঐ বাড়ির ছোট ছেলের বউ হব। ব্যাপারটা কেমন যেন নাটকীয় লাগতো।  তবে আগেকার দিনে নাকি এভাবেই বিয়ে ঠিক করা হত। আমার জন্মের পর দেখতে খুব কালো আর বেশ মায়াবী চেহারার ছিলাম। মায়া আম্মা প্রথম যেদিন আমাকে দেখতে গিয়েছিলেন তখন, সেদিনই নাকি আমার আম্মুকে বলেছিলেন "এই মেয়েটাই আমার ছোট ছেলের বউ করে নিবো।" এক প্রকার দাবী-ই করেছিলেন কিনা। যেটা আজো সবাই মনে রেখেছে। তবে ভাগ্যের খেলা কোথায় গিয়ে শেষ হবে তা আমরা কেউ জানি না। সেই রেশ আমার অনেক দিন ছিল, এখনো মাঝে মাঝে জেগে উঠে। আবার আপনা থেকেই থেমে যায়।



এই হল আমার ঘরোয়া শৈশব। এর বাইরে বলতে গেলে অনেক গুলো নাম বলতে হয়। বিপু, রান্নিক, ফারজানা, সৈকত, পলাশ, মিতু, লতা, ইভা, দোলন, সালমা, লামিয়া, তুষ্টি, কামরান, ফাহিম, তিথী, সুমি, স্মৃতি, সঞ্চিতা, অভি, প্রীতম, নাঈম, শামীমা, ঝুমা, পিংকি, রুবাইয়া আরো কত নাম হারিয়ে গেছে কালের বিবর্তনে।


আমার সেই প্রথম স্কুল জীবনের শুরু ২০০১ সাল, তারপর তিন বছর কিন্ডারগার্টেনে পড়ে ভর্তি হই প্রাইমারি স্কুলে ২০০৪ এ ক্লাস থ্রি-তে। কিন্ডারগার্টেন জীবনে বিপু আর রান্নিক ই ছিল সবচেয়ে কাছের বন্ধু, আর এখনো আছে। আমরা তিনজন সব সময় কম্পিটিশনে থাকতাম। তবে প্রতিবার আমারই রোল এক হত। ফারজানা আর আমি একসাথে বসেছি তিনটা বছরের কিন্ডারগার্টেন জীবনে।



তারপর প্রাইমারি স্কুলে এসে প্রথম পরিচয় দোলন আর ইভার সাথে। ক'দিনের মধ্যেই উদঘাটন করি পাশের বাসার কামরান নামের ছেলেটাও এই স্কুলে পড়ে। প্রায়ই আমরা দুজন একসাথে স্কুলে আসা যাওয়া করতাম। আর আন্টি সব সময় বলতেন, আমি উনার মেয়ে, কামরান আর আমি ভাই-বোন। প্রাইমারি স্কুল জীবনের তিনটা বছর ছায়ার মত আগলে রেখেছে পাগলটা। আমাকে "পারু" বলে ডাকতো, এখনো সেই নামেই ডাকে। এখনো আগলে রাখে, আর আমার যত রাগ-অভিমান সব তার উপর ঝারি সব সময়। সে খুব ধৈর্যের সাথে সহ্য করে নেয়। হা হা হা!!!!


বিকেলবেলার খেলার সময় পার করতাম নাঈমদের কোয়ার্টার এর সামনের দুই-তিনটা পেয়ারা গাছতলায়। সাথে লতা, মিতুও থাকতো। লতা পাশের বাসায় থাকতো, এখন সে-ও সংসারী হয়ে গেছে। ভাল বর পেয়েছে সাথে তার নিজের ছেলে সন্তান। স্রষ্টা তাকে দুহাত ভরে দিয়েছেন। মিতু ছিল সবার ছোট। আমার আম্মুকে আম্মু ডাকতো ছোটবেলা থেকেই। আর এখন তো পাগলীটা বেশ বড় হয়ে গেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিভাগে পড়ালেখা করছে।



অনেকেই আজ অনেক দূর।  নাঈম, প্রীতম ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছে। অভি মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছে। দোলন ইডেন কলেজে খুব সম্ভবত কেমিস্ট্রিতে অনার্স পড়ছে। ফাহিম আছে কিশোরগঞ্জে, ডেন্টাল মেডিকেলে পড়ে। বিপু জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে। রান্নিক জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং নিয়ে পড়ছে। কামরান আছে নর্থ সাউথের ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে অধ্যয়নরত। সৈকত ডাক্তারি পড়ছে একটি সরকারি মেডিকেল কলেজে। পলাশ আমেরিকায় বিবিএ তে পড়ছে। শামীমার বিয়ে হয়েছে প্রায় নয় বছর যাবৎ, আর ছেলে সন্তান আছে একটা। বেশির ভাগ মেয়ে বান্ধবীদেরই বিয়ে হয়ে গেছে, কেউ কেউ আবার পড়ালেখাও করছে। এদের নিয়েই ছিল আমার স্মৃতিময় শৈশব।

     কালে কালে বেলা হল, কথা হল সারা,
      নেই যারা কাছে আজ, পর হল তারা।
    স্মৃতি আছে, রীতি আছে, আছে পথচলা,
     কত কথা জমে আছে, হয় না আর বলা।

Comments